December 22, 2024, 8:08 am
ড. আমানুর আমান, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দ্য কুষ্টিয়া টাইমস/
বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ রাসেল নামটি একটি ব্যথার নাম, একটি কান্নার নাম; বেদনার রঙে রাঙানো বুক ভার করা ইতিহাসের সেই জায়গা থেকে উঠে আসা এ নাম যেখানে সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে ; ইতিহাসকে থামিয়ে দিয়েছে ; ইতিহাসের বুকে একটি প্রশ্ন এঁকে দিয়েছে। প্রশ্নটি এত নির্মম যে এর উত্তর একদিকে অধিক শোকে চাপা কান্নার মতো শোনায় এবং একই সাথে বিসুভিয়াসের মতো উদ্গীরণ হয়ে বেড়িয়ে আসে। শেখ রাসেল আমাদের কাছে যেমন নির্মম শোকের প্রতীক, শেখ রাসেল তেমনী আমাদের কাছে বিসুভিয়াসের উদ্গীরণ থেকে বেড়িয়ে আসা দাবানলের মতোই। কারন ৭৫’র বিচারহীন নির্মমতার বিপরীতে আজ পর্যন্ত সেই নির্মম-নিষ্ঠুর খুনীদের বিচারের প্রতিটি আন্দোলনে শেখ রাসেল নামটি বারবার বাঙালীর রক্তকে টগবগ করে জ¦ালিয়ে দিয়েছে। রাসেলের রক্তধারা একটি জাতির আবেগকে নির্মাণ করেছে। শুধু তাই নয় শিশু রাসেলের উপর সংঘটিত অমানবিক নিষ্ঠুরতা এ ভূ-খন্ড ছাড়িয়ে বিশ^ মানবতাকে ছুঁয়ে দিযেছে ; বারবার সচকিত করেছে ; খুনীদের বিরুদ্ধে নিয়ে গেছে। শিশু রাসেলের সেদিনের সেই নিস্পাপ রক্তধারা আজ বিশ^জুড়ে মানবতার প্রতীক।
শেখ রাসেল ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। তাঁর সম্পর্কে ইতিহাস থেকে তথ্য নিয়ে বলবার জায়গাটি কম। তবে ১১ বছরের জীবদ্দশায় রাসেলকে ঘিরে ইতিহাসের ছিটেফোটা তথ্য আমাদের অনেক কিছুই জানিযে যায়। রাসেলের শৈশব, বেড়ে ওঠা, আচরণ, কর্মকান্ড সবই আর সব সাধারণ শিশুর মতো ছিল না। রাসেল যে পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেটিই হয়তো তার কারণ।
ইতিহাস জানাচ্ছে যখন রাসেলের জন্ম হয় সেই ১৮ অক্টোবর ১৯৬৪ ; তখনকার বাংলা ভূ-খন্ডের পরিস্থিতি ছিল ডামাডোলপূর্ণ ; যার পুরোটাই ছিল রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের। পুরো পাকিস্থান জুড়েই যখন কঠিন অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার ; পাকিস্থানের পূর্ব অংশজুড়ে ভিন্নমুখী আন্দোলন। এর মাঝেও এ অঞ্চলের মানুষ যখন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন, ঠিক তখনই মুজিব-ফজিলাতুন নেছার ঘর আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিলেন আমাদের এই ছোট্ট শিশুটি। যার নাম রাখা হয় ‘রাসেল’। এই নামকরণেরও একটি প্রেক্ষাপট ছিল যা ছিল স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক।
ইতিহাস থেকে জানা যায় বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবী বিখ্যাত নোবেলজয়ী ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল শুধু একজন দার্শনিকই ছিলেন না, বিজ্ঞানীও ছিলেন ; ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্বনেতাও। আর বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য বার্ট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন ‘কমিটি অব হানড্রেড’ যার লক্ষ্য ছিল মানুষের বসবাস যাতে সুন্দর ও শান্তিময় হয়। বঙ্গবন্ধু নিজ ই”ছায় বার্ট্রান্ড রাসেলের সাথে মিলিয়ে তার প্রিয় সন্তানের নাম রেখেছিলেন।
সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজ ফুফু মা’র সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’
শিশু রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে বাবা মুজিবকে ছাড়া। কারণ, বাবা মুজিব রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে ছিলেন দিনের পর দিন। আর চোখের সামনে বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে একপর্যায় ‘আব্বা’ বলেই সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন শিশু রাসেল, ঠিক তেমনি বাবা মুজিবও।
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের একুশ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অব¯’া কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।’
অন্যদিকে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো।’ কী উত্তর ওকে আমি দেব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কী বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিš‘ রাসেল এখনও বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’
নানা তথ্য ও স্টাডিতে দেখা যায় সেই ছোট্ট বয়স থেকেই রাসেলের ছিল অসাধারণ নেতৃত্বসুলভ আচরণ। ঢাকায় তার তেমন কোনও খেলার সাথি ছিল না, কিš‘ যখন পরিবারের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় বেড়াতে যেতেন, সেখানে তার খেলার সাথির অভাব হতো না। রাসেল নিজেই বা”চাদের জড়ো করতেন, তাদের জন্য খেলনা বন্দুক বানাতেন, আর সেই বন্দুক হাতেই তাদের প্যারেড করাতেন। আসলে রাসেলের পরিবেশটাই ছিল এমন। রাসেলের খুদে ওই বাহিনীর (বন্ধু) জন্য জামা-কাপড় ঢাকা থেকেই কিনে দিতেন। প্যারেড শেষে সবার জন্য খাবারের ব্যব¯’াও করতেন। আর বড় হয়ে তুমি কী হবে এমন প্রশ্ন কেউ করলে, রাসেল বলতো ‘আর্মি অফিসার হবো’।
রাষ্ট্রপতির সন্তান হওয়া সত্তে¡ও রাসেলের কোনো অহমিকা ছিল না। ইউনিভার্সিটি ল্যাব. স্কুলে পড়ার সময় অন্য বন্ধুদের সাথে পড়াশোনা করতেন। পরবর্তীতে একাত্তরের পুরো সময় বন্দি অবস্থায় রাসেল স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের গান শুনতেন।
আসলে রাসেলের সবকিছুতেই একটু ব্যতিক্রম ছিল, আর থাকবে নাই বা কেন? সে যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। তার মন-মগজ আর শরীরের প্রতিটি শিরায় উপ-শিরায় বহমান ছিল ব্যক্তিত্ব, মানবতাবোধ আর ভিন্নতা।
প্রেক্ষাপট ১৫ আগস্ট/
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সময়টিতে রাসেলের মাত্র ১১ বছর বয়স। ঐ কালো রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সসদ্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন তিনি। ইতিহাস বলছে পৃথিবীতে যুগে যুগে বহু রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটেছে কিš‘ এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকান্ড কোথাও ঘটেনি। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিতে-নিতে শিশু রাসেলকে আতঙ্কিত করে তোলা হয়েছিল ; সেদিন এভাবে মানসিকভাবেও খুন করা হয়েছিল। আতঙ্কিত শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ে কাছে যাব’। তাকে মায়ের কাছে নেয়া হয়েছিল। কিš‘ সেটি ছিল মায়ের লাশের কাছে। মায়ের লাশ দেখে অশ্রæসিক্ত কণ্ঠে শিশু রাসেল মিনতি করেছিলেন ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’।
সবার লাশ দেখানোর পর সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল রাসেলকে।
এ হত্যাকান্ড সাধারণ বিবেককেও স্তব্ধ করে দেয়। কিš‘ সেদিন খুনীরা উল্লাসে মেতেছিল। সদম্ভে তারা এই ভয়াবহ কুকর্মের জাহির করতে নেমেছিল। পট পরিবর্তনের নায়কদের দ্বারা পুরস্কৃত পর্যন্ত হয়েছিল।
রাসেল স্বাধীনতার ¯’পতি শেখ মুজিবের ছেলে এটাই হয়তো ছিল তার একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ।
‘কেন কেন কেন আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল ? আমি কি কোনোদিন এই ‘কেন’র উত্তর পাব ?’ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এই আকুতি ভরা কেন’র জবাব কে দেবে?
এ প্রসঙ্গে শিশু রাসেল-কে নিয়ে লেখা দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিশুরক্ত’ কবিতাটি খুব মনে পড়ছে-
‘তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরি”ছন্ন বয়সেতে ছিলি!
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্তপানে তার গ্লানি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই। ’
রাসেলকে নিয়ে ভাবনা/
দখলদার পাকিস্থানী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, বাঙালির বাঁচার দাবি ছয় দফা প্রণয়ন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশগঠনের প্রচেষ্টা এতোসব কর্মমুখর সময়ের মধ্যে যিনি জন্ম নেন ও বেড়ে ওঠেন, তিনি শেখ রাসেল। বাঙালি জাতির জন্মলগ্নের তাৎপর্যপূর্ণ সময়গুলোজুড়ে কেটেছিল তার শৈশব। বাল্যকালেই যে সচেতনতা ও কোমল ব্যক্তিত্বের প্রতি”ছবি ফুটে উঠেছিল তার যাবতীয় কর্মকান্ডে, বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে হয়তো তিনি আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত কোনো মানবদরদী নাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতেন, হয়তো হতে পারতেন একজন দেশপ্রেমিক সামরিক অফিসার, হয়তো আধুনিক বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ।
আমাদের প্রয়োজন, ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের মানবতাবোধ, ছোট বয়সেই নেতৃত্বসুলভ আচরণ, পরোপকারী মনোভাবগুলো আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। শেখ রাসেলকে নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনও গবেষণা নেই (আমার জানা মতে)। শেখ রাসেলের প্রিয় হাসু আপা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার (আমাদের ছোট রাসেল সোনা) স্মৃতিচারণ বইটিও এখনও আমাদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। অন্যদিকে গীতালি দাশগুপ্তা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পড়াকালীন ছাত্র রাসেলের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন মজার কথাগুলোও আমরা আজও ডিজিটাল ডিভাইস, সফটওয়্যার বা অ্যাপস আকারে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে-হাতে পৌঁছে দেয়া যেতে পারে।
Leave a Reply